সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান ১৭ জন। তাঁদের প্রত্যেকের কর্মী-সমর্থক রয়েছে। কে কাকে টেক্কা দিয়ে মনোনয়ন নিতে পারবেন সেই প্রতিযোগিতা থেকে স্থানীয় পর্যায়ে চলছে মহড়া। তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব ও প্রবল উত্তেজনা। ওই জেলার বিভিন্ন উপজেলার আরো বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ঘিরে একই পরিস্থিতি।
এদিকে প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের বিরাগভাজনদের তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সে কারণে আওয়ামী লীগ এবার দলের মনোনয়ন ফরম সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১১ নভেম্বর সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য গত শনিবার থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন হাজার ৯৬৫টি মনোনয়ন ফরম বিতরণ করা হয়। আজ বুধবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম উত্তোলন ও জমা দেওয়া যাবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, এরই মধ্যে শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ জমা পড়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে আছে ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, বিএনপি ও জামায়াত পরিবার থেকে আওয়ামী লীগে আসা এবং সরকারি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নির্যাতন।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের কয়েকটির বিবরণ আওয়ামী লীগের একটি সূত্রে পাওয়া গেছে। ওই সূত্রটি কালের কণ্ঠকে জানায়, বান্দরবানের লামা উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমা। তাঁর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদের কপিও যুক্ত করা হয়েছে। ছাচিং প্রু মারমার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ করা হয়েছে। এগুলো হলো—ধর্ষণ, টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও জন্ম সনদ বাণিজ্য, ভূমিহীনদের ঘর দিতে ঘুষ নেওয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, রাস্তার ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বিতরণে বাণিজ্য। এর মধ্যে ধর্ষণ ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ফিরোজ খান। তাঁর বিরুদ্ধেও লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ দেওয়া হয়েছে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের কাছেও। লিখিত অভিযোগে ফিরোজ খানকে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এবং তিনি রাজাকার পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নবীদুলের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির সংবাদের কাটিং যুক্ত করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদরের খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশীদুল হাসান রশীদের বিরুদ্ধেও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সুদের ব্যবসা, দলের ত্যাগী ও পুরনো নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম ও হয়রানির অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দোয়ারাবাজার ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আবুল মিয়া। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা দেওয়া একটি লিখিত অভিযোগে আবুল মিয়াকে রাজাকারের নাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘আমাদের দপ্তরে অভিযোগ জমা নেওয়া হচ্ছে। একটি রেজিস্টার খাতাও খুলেছি। সেখানে অভিযোগ আসছে। তৃণমূল থেকে রেজল্যুশন আকারে যে তালিকা পাঠানোর কথা সেখানে কোনো অনিয়ম থাকলে তা মনোনয়ন বোর্ডের সভায় উত্থাপন হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের এসব বিষয় সুরাহা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁরা বিষয়গুলো দেখছেন।’
কী ধরনের অভিযোগ আসছে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘দলের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকে। বড় দলে এটা স্বাভাবিক। অনেকেই নানা অপকর্ম, দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের জানাচ্ছেন। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি। শুধু দলীয়ভাবেই নয়, সরকারের পক্ষ থেকেও নানা মাধ্যমে এসব বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’
প্রভাবশালীদের অপছন্দের কারণে বাদ
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পূর্ব জুড়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি এর আগেও দুইবার একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু এবার তৃণমূল আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় নাম নেই তাঁর। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব থাকায় তাঁকে এই তালিকায় রাখা হয়নি বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে আলাদা অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন সালেহ উদ্দিন। সেই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, যারা নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছে, যারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছে তাদের নামও প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি আমার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অনেক নেতার কাছেই গেছি। কিন্তু কেউই আমার জীবনবৃত্তান্ত গ্রহণ করেননি। কেন করেননি তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।’
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিসবাউর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা দলের উপজেলা কমিটির কাছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত চেয়েছিলাম। কিন্তু সালেহ উদ্দিনের জীবনবৃত্তান্ত আমাদের কাছে পৌঁছেনি। সে জন্য তাঁর নাম তালিকায় নেই।’
জানা গেছে, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কাপাসিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এম এ খালেক কাপাসিয়ার টোক ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় তৃণমূলের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এম এ খালেক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমাকে পছন্দ করেন না। উনার পছন্দের লোক হলেন টোক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ জলিল। এর আগেও এম এ জলিলকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি হেরে যান। এবারও তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার লক্ষ্যেই তৃণমূল তালিকা থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
মনোনয়ন ফরম উন্মুক্ত
প্রভাবশালীদের নিজের পছন্দের লোকদের তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় রেখে অপছন্দের লোকদের বাদ দেওয়ার তথ্য আছে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও। এ বিষয়টির সুরাহা করতে দ্রুততার সঙ্গে মনোনয়ন ফরম আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় দলটি। এর আগে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই ছয়জনের স্বাক্ষরসহ তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় নাম থাকতে হতো। এবারে পরিস্থিতি বুঝে ওই পথে হাঁটেনি আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় রাজনীতির জন্য কারো নাম তৃণমূলের তালিকায় না এলেও সমস্যা নেই। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের তালিকা বিশ্লেষণ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং মনোনয়ন বোর্ড।’
সূত্র- কালের কন্ঠ