সাকিবুর রহমানঃ
কক্সবাজারে বন উজাড় ও পাহাড় কেটে বসত ঘর তৈরিসহ নানা কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে প্রতি বর্ষায়।
তবু ‘মরলে পাহাড়ে মরব, বাঁচলে পাহাড়ে বাঁচব’—এমন মনোভাব নিয়ে পাহাড় ছাড়তে রাজি নন সেখানে বসবাসকারীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গেল আট বছরে পাহাড় ধসের ঘটনায় অন্তত ২২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক।
প্রশাসন নানাভাবে চেষ্টা করেও পাহাড় থেকে লোক সরাতে পারছে। আবার আইন করেও আটকানো যাচ্ছে না পাহাড়খেকোদের।
২০১০ সালের জুন মাসে কক্সবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় সাত সেনা সদস্যসহ ৫৬ জনের মৃত্যু হয়।
আর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজার শহরের বাহার ছড়ায় ভয়াবহ পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিনজনসহ প্রাণ হারায় পাঁচজন।
কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী, সার্কিট হাউজ, টেকনাইফ্যা পাহাড়, হিমছড়ি, মহেশখালী উপজেলাসহ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় পাহাড় ধস প্রতি বর্ষা মৌসুমের নিয়মিত ঘটনা। প্রতি বছর ছোট-বড় পাহাড়ধসে মারা যায় বহু লোক।
এত ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করার কারণ জানতে চাইলে পাহাড়তলী হেলালী ঘোনার আব্দুল বলেন, ‘আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। দিন মজুরি করে সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারি না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পাঁচ বছর আগে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ২ শতক পাহাড়ি জমি কিনে কোনো মতে টিন দিয়ে ঘর তৈরি করে বসবাস করছি। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। মরলে পাহাড়ে মরব, বাঁচলে পাহাড়ে বাঁচব।’
একই কথা বলেছেন বাঁচা মিয়ার ঘোনার আব্দুল হালিম, বাদশাঘোনা এলাকার মৌলভী হাফেজ আলম, পাহাড়তলী ইসলামপুরের মো. আমিন, বৈদ্যঘোনার ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি মো. হোসেন, কলাতলী চন্দ্রিমার ঘোনার বিধবা খায়রুন্নাহার ও বাদশার ঘোনার হোসনে আরা বেগম।
তারা আরও বলেন, সরকার আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করলে আমরা এসব পাহাড় ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম জানান, কক্সসবাজার শহরের আদর্শগ্রাম, কলাতলী, সিটি কলেজ এলাকা, পাহাড়তলী, ঘোনার পাড়া, খাজা মঞ্জিল ও বৈদ্যঘোনাসহ বিভিন্ন এলাকার ২০টির বেশি স্থানে দুই লাখের বেশি মানুষ চরম ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাস করছে।
আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হলে ফের পাহাড়ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে কক্সবাজারের পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, যারা পাহাড় কাটছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এই পর্যন্ত ১৪৫টিরও বেশি মামলা হয়েছে। তবে পাহাড় খেকোরা বরাবরেই সক্রিয় রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-সহকারী পরিচালক সংযুক্তি দাশ গুপ্তা বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধ ও বসতি উচ্ছেদের জন্য গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।
‘এ সময় শতাধিক নতুন করে তৈরি ঘরবাড়ি উচ্ছেদ ও পাহাড় কাটার দায়ে মামলা ও জরিমানা করা হলেও আরও বহু অবৈধ স্থাপনা রয়ে গেছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদে যৌথ অভিযান দরকার। কিন্তু আমাদের লোকবল সংকটের কারণে একসঙ্গে এত অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, বৃষ্টি হলে পাহাড় কাটার কারণে মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ে। যদি বর্ষাকালে টানা বর্ষণ হয় তা হলে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীর পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র (২) কাউন্সিলর হেলাল উদ্দিন কবির বলেন, দেশের জলবায়ু উদ্বাস্তু দেড় লাখ মানুষের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে বর্তমানে বসবাস করছে আরও অন্তত ২ লাখ বেশি রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি তৈরির জন্য প্রতিদিন পাহাড় কাটছে। অনেকে বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে পাহাড় কাটে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে শহরের নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে যায়। ফলে পুরো শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
পাহাড় কাটা রোধে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও কক্সসবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান বলেন, বর্ষাকাল এলেই পাহাড়ে বসবাসকারী লাখো মানুষকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। পাহাড় ধসে প্রতি বছর বহু মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু মাথা গোঁজার বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়ায় পাহাড় থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না।